ফলন ভালো হলেও ফল ছোট, আর্থিক ক্ষতির মুখে লিচু বাগান মালিকরা

নিজস্ব প্রতিনিধি:
  • আপডেট টাইম সোমবার, ১৬ মে, ২০২২
  • ৩৬০ টাইম ভিউ
লিচু বাগান

শুরু হয়েছে মধু মাস। পাকা শুরু করেছে আম। আর মিষ্টি মধুর রসে ভরা লিচুর চলছে ভরা মৌসুম। চারিদিকে লিচুর মিষ্টি মধুর ঘ্রাণ। গাছের ডালে ডালে ভিড় করেছে মৌমাছি। গাছ থেকে নামানো হচ্ছে লিচু। সেগুলো বাছাই শেষে গুণে গুণে করা হচ্ছে আটি (বোটাসহ)। এরপর এসব লিচু ঝুড়িতে সাজিয়ে বিক্রির জন্য ভ্যানে করে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন আড়তে।

সোমবার (১৬ মে) নাটোরের বিভিন্ন লিচু বাগান ঘুরে দেখা গেছে এমন দৃশ্য। গাছ থেকে লিচু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাগান মালিক ও শ্রমিকরা। সেসব লিচু বাছাইয়ের কাজ করছেন নারী-পুরুষ সবাই মিলে।

বৈশাখ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয় লিচু সংগ্রহের কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে আড়তগুলোতে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের কর্মব্যস্ততা। বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসে লিচু কিনে ট্রাকযোগে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যান।

নাটোর  অঞ্চলের আবহাওয়া লিচুর জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় এখানে প্রচুর পরিমাণে লিচুর বাগান গড়ে উঠেছে। এখানকার লিচু রসালো ও স্বাদ বেশি হওয়ায় এর সুনাম রয়েছে সারাদেশ জুড়ে। এই কারণে নাটোরের বিভিন্ন বড় বড় বাজার ও নাটোর-ঢাকা রোডের পাশে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল লিচুর আড়ত। ফলে স্থানীয় অনেক যুবকের কর্মসংস্থানের সুযোগও হয়েছে।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ মৌসুমে নাটোর জেলায় ৯২৪ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ৭ হাজার ৮৯৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে নাটোর সদরে ১৬০ হেক্টর, গুরুদাসপুর উপজেলায় ২১০টি বাগানে ৪১০ হেক্টর, নলডাঙ্গা উপজেলায় ১৫ হেক্টর, সিংড়া উপজেলায় ৯৮ হেক্টর, বড়াইগ্রাম উপজেলায় ৪০ হেক্টর, লালপুর উপজেলায় ১০৫ হেক্টর এবং বাগাতিপাড়া উপজেলায় ৯৬ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করা হয়েছে।

তবে, জেলার সবচেয়ে বেশী গুরুদাসপুর উপজেলায় ২১০টি বাগানে ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। যার পরিমান আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন । গত বছরের চেয়ে এ মৌসুমে ১০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের লিচু বাগান মালিক প্রভাষক মাহমুদুল হাসান রিজভী বলেন, “আমার দুই বিঘা জমিতে ৩০টি গাছ রয়েছে। এ মৌসুমে লিচুর বেশ ফলন ভালো হয়েছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে লিচুর আকার ছোট হওয়ায় আসানুরুপ মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না।”

একই গ্রামের গৃহিণী ইভা সিদ্দিক নূপুর বলেন, “এ বছর লিচুর ফলন ভালো হয়েছে। তবে বৃষ্টির অভাবে ফল ছোট। যদি এই লিচুর দাম কিছুটা বাড়ে, তাহলে আমরা লাভবান হবো।”

উপজেলার নাজিরপুরের মেহেদী ফল ভাণ্ডার আড়তের স্বত্বাধিকারী আব্দুল মান্নান জানান, “গুরুদাসপুরে লিচুর উৎপাদন বাড়ায় ১৫ থেকে ২০টি লিচুর আড়ত গড়ে উঠেছে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক ভর্তি লিচু নিয়ে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান।”

আল্লাহর দোয়া ফল ভাণ্ডার আড়তের স্বত্বাধিকারী সেলিম হোসেন জানান, “এ বছর লিচুর উৎপাদন বেশি হলেও দাম অত্যন্ত কম। গত বছরের তুলনায় এ বছর লিচুর দাম পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর ২২শ থেকে ২৪শ টাকায় আড়তে লিচু কেনাবেচা হয়েছে। এ মৌসুমে আড়তে প্রতি হাজার লিচু প্রকারভেদে ১২শ থেকে ১৭শ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে।”

বাংলাদেশ ফল ভাণ্ডার আড়তদার রফিকুল ইসলাম জানান, “এ বছর বৃষ্টির কারণে লিচুর আকার ছোট হয়েছে। বাজারে তেমন পাইকারি ব্যবসায়ীও নেই। যার কারণে লিচুর দাম কম। যদি লিচুর দাম না বাড়ে তাহলে বাগান মালিকরা লোকসানে পড়বে। একটি আড়তে মৌসুমে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ হয়। সেই সঙ্গে আড়দাররাও ক্ষতির মুখে পড়বো বলে তিনি জানান।”

চাঁদপুর জেলা থেকে আসা পাইকারি লিচু ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন, ”প্রতিবছর এখান থেকে লিচু কিনে নিয়ে চাঁদপুরে বিক্রি করি। এখানকার লিচু অনেক রসালো ও মিষ্টি। অনেক সুস্বাদু হওয়ায় এ এলাকার লিচুর অনেক চাহিদা রয়েছে। তাই চাঁদপুর থেকে আসি এখানকার লিচু কিনতে। এখানকার লিচু বিক্রি করতে তেমন অসুবিধা হয় না।”

ঢাকা থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ী ফরিদুল ইসলাম বলেন, “৪ বছর ধরে এ মোকাম থেকে লিচু কিনে ঢাকায় নিয়ে বিক্রি করি। এলাকার লিচুর আকার, রঙ, স্বাদ অনেক ভালো। এছাড়াও এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থা অনেক ভাল। এজন্য এখান থেকে লিচু ক্রয় করে ঢাকায় বিক্রি করি। তবে এবারে লিচু আকারে ছোট।”

যশোর থেকে আসা ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান জানান, “আড়তে লিচুর আমদানি পর্যাপ্ত রয়েছে। কিন্তু এ বছর লিচুর আকার কিছুটা ছোট। যার কারণে দামও কিছুটা কম। তবে লিচুর আকার বড় হলে চাহিদা ও দাম বিক্রি করা যায়।”

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদুল ফারুক বলেন, “এ বছর নাটোরে ঝড় ও শিলাবৃষ্টি না হওয়ায় লিচুর ফলন বেশ ভাল হয়েছে। কৃষকরা গাছ থেকে লিচু সংগ্রহ শুরু করেছে। বাজারে ভাল দামও পাচ্ছে। জেলার গুরুদাসপুর উপজেলায় লিচুর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এ অঞ্চলের লিচু বেশ রসালো ও সুস্বাদু হওয়ায় সারাদেশে পরিচিত রয়েছে।”

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনর রশিদ জানান, “গুরুদাসপুরে ৪১০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়েছে। যার উৎপাদন ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন লিচু। গত বছরের চেয়ে এ মৌসুমে ১০ হেক্টর বেশি আবাদ হয়েছে। লিচুর আবাদ বৃদ্ধি করতে জেলার কৃষি বিভাগ সময় মতো কৃষকদের সব রকমের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। এখানকার লিচু সুস্বাদু হওয়ায় বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা তা ক্রয় করে। এরপর দেশের বিভিন্ন জেলায় লাভে বিক্রয় করে থাকেন।”

এই বিভাগের আরও খবর
© All rights reserved © 2019 SSB24.COM
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com